টঙ্গী থেকে রাজধানীর খিলক্ষেত ওভারব্রিজ পর্যন্ত হেঁটেছি। দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৯ কিলোমিটার। সময় লেগেছে দেড় ঘণ্টার মতো। দিনে এতটুকু সময় তো হাঁটাই যায়। স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। গত বুধবার রাতে এতটুকু রাস্তা হেঁটে এসে আবার ফেসবুকে পোস্টও করলাম। অনেকে অবাক হয়েছেন। এতটা পথ কি আবার হাঁটা যায়?
এটা ‘উন্নয়নের পথ, উন্নয়নের মহাসড়ক’। এই মহাসড়কে উন্নয়নের কাজ চলছে বহুবছর ধরে। চলবে আরও বহুবছর। আপনিও হয়তো একদিন এ পথে এভাবে যৎসামান্যই হাঁটবেন!
আচ্ছা, রাজধানীতে এই রুটে যখন প্রথম বাস চালু হয়েছিল, তখন সেই বাসে যারা যাত্রী ছিলেন তাদের অনুভূতি কেমন ছিল? তারাও হয়তো ফেসবুকে লিখতেন, ‘এই প্রথম টঙ্গী থেকে রাজধানীর খিলক্ষেত পর্যন্ত বাসে এলাম।’ কিন্তু তখন ফেসবুক ছিল না। তারা ফেসবুকে লিখতে না পারলেও হয়তো সে কথা পরিচিতদের কাছে বলেছিলেন। অথবা ডায়েরিতে লিখেছিলেন।
যে ‘মহাভুল’ করেছি
রাজধানী ঢাকা থেকে নেত্রকোনায় যেতে এখন একটি পথ যথাসম্ভব পরিহার করি। বিমানবন্দরের পর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা। উন্নয়ন কাজের কারণে এই মহাসড়কে তীব্র যানজট লেগে থাকে। তাই এ পথে না গিয়ে ট্রেনে যাই। আবার আসিও ট্রেনে। সবসময় আর ট্রেনের শিডিউল ধরা যায় না।
গত বুধবারও ধরতে পারিনি। বাধ্য হয়ে বাসে উঠি। নেত্রকোনা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত একটি বাসে এলাম। ছোট্ট বিরতির পর ঢাকার বাসে উঠি।ময়মনসিংহ থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা চার লেনের। যানজট থাকে না তেমন।
বিকাল ৫টার দিকে চৌরাস্তায় এসে ‘মহাভুল’ করলাম। প্রায় সময় এখানে এসে বাস থেকে নেমে যাই। চলে যাই জয়দেবপুর। সেখান থেকে ট্রেনে করে বিমানবন্দর স্টেশনে আসি। মাত্র ১৫ মিনিটের মতো লাগে।
এদিন আমার হাতে পর্যাপ্ত সময়। ভাবলাম, এতো সময়, বাসে করেই যাই। সাধারণত যানজটের মধ্যেও গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে আসতে দেড়-দুই ঘণ্টা সময় লাগে। হাতে তো সাড়ে ৬ ঘণ্টা। রাত সাড়ে ১১টায় আমার ডিউটি। অফিসে সময়মতো যেতে সমস্যা হবে না। এর অনেক আগেই বাসায় পৌঁছে যাব। অনেকক্ষণ বিশ্রামও নিতে পারব।
কিন্তু এদিন তীব্র যানজট। সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাস বোর্ডবাজার এলাকায় পৌঁছাল। টঙ্গী আসতে লেগেছে আরও ২ ঘণ্টা। এরপর তো বাস আর চলে না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমনকি মোটরসাইকেলগুলোও ঠাঁই দাঁড়ানো।
রাত ৯টা। ভাবলাম, আর বসে থাকা যায় না। এই বাস সময়তো আমার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না। বাসের হেলপারকে বললাম, ভাই- এখান থেকে আব্দুল্লাপুর হেঁটে যেতে কতক্ষণ লাগতে পারে? তিনি জানালেন, ২০ মিনিট।
আমরা হাঁটছিলাম, নাহলে ‘বাসেই ঘুমাতে হবে’
বাস থেকে নেমে গেলাম। হাঁটা শুরু করলাম। বহু মানুষও হাঁটছেন। আব্দুল্লাপুর আসতে ১৫ মিনিট লেগেছে। কিন্তু এখানেও বাস নড়ে না। প্রায় খালি বাসগুলো দাঁড়িয়ে আছে। বাসে অল্পকিছু যাত্রী এখনো যানজট কমার আশায় প্রহর গুনছেন।
আমি হাঁটছি। বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা কর্দমাক্ত। হাঁটার রাস্তায়ও ভিড়। কারণ, বাসগুলোর বেশিরভাগ যাত্রীই এই পথে হাঁটছেন।
কিছুক্ষণ পর ফুটপাতের পাশের এক দোকানির কথা কানে ভেসে এলো। তিনি বাসে বসে থাকা বাকি যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘আজ আর বাড়ি যেতে হবে না। বাসেই ঘুমাতে হবে।’
‘এভারেস্ট জয় করলাম’
উত্তরার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি। ড্রেনের কাজ চলছে। মাটি কেটে ফুটপাতে রাখা হয়েছে। যেন টিলার মতো। আমার পেছন থেকে এক তরুণী বলছিলেন, ‘এভারেস্ট জয় করলাম।’ কর্দমাক্ত পিচ্ছিল টিলা পেরিয়ে তার এই মন্তব্য।
ঘটনা কী?
অনেকেই বলছিলেন, ঘটনা কী? এরকম যানজট তো ঈদের সময়ও হয় না। কোনো কিছু ঘটছে নাকি? মিটিং-মিছিল-মারামারি? এই প্রশ্ন আমার মনেও। বিমানবন্দর এলাকায় এসে এক ট্রাফিক পুলিশের কাছে জানতে চাইলাম, আজ এত যানজট কেন? তিনি বললেন, ‘ঠিক বুঝতেছি না কী কারণে, সকাল থেকেই এমন যানজট।’
বিমানবন্দর পার হওয়ার পর দেখলাম, যানজট নেই। কিন্তু গণপরিবহনও নেই। রাস্তার দুই পাশে মানুষ, বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমার হাতে সময় নেই। রাতে ডিউটি। অফিসটাইম ধরতে হবে। হাঁটা অব্যাহত রাখলাম। তখন ফাঁকা রাস্তায় কয়েকটি প্রাইভেট গাড়ি চললো দ্রুতগতিতে। দুটি বাসও এলো যাত্রীবোঝাই করে, কিন্তু আমার গন্তব্যের নয়। গন্তব্যের হলেও উঠার সুযোগ ছিল না।
টেনশন ছিল একটাই
রাত সাড়ে ১০টায় খিলক্ষেত ওভারব্রিজের কাছে এলাম।একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা পেলাম। যমুনা ফিউচার পার্কে আসতে ২০০ টাকা চাইল। দেড়শ টাকায় এলাম। লাগল মাত্র ৫-৬মিনিট। তবে পার্কের সামনে থেকে বাড্ডা রুটে আবার যানজট। যদিও কিছুটা কম। তাই অনেকটা আগেই নামতে হলো। যাইহোক, বাসায় ফিরলাম। নির্দিষ্ট সময়ে অফিসেও যেতে পারলাম। শুকরিয়া। টেনশন ছিল একটাই, অফিসে যেন সময়মতো যেতে পারি।
রাতে অফিস না থাকলে পুরো পথই হেঁটে বাসায় আসতাম। কারণ, একা হাঁটছিলাম না। রাতের ঢাকায় বহুমানুষের এভাবে হাঁটা আর দেখিনি। অনেকটা পিকনিকের মতো লাগছিল!
লেখক : জুনাইদ আহমেদ, গণমাধ্যমকর্মী